ঢাকায় শুরু হলো ই-কমার্স নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ সামিট ‘উইমেন ই-কমার্স এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ সামিট (উই সামিট) ২০২৩’। নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করা দেশের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট (উই) এর উদ্যোগে সারা দেশ থেকে আসা নারী উদ্যোক্তা ও খাত সংশ্লিষ্ঠদের অংশগ্রহণে এই দুইদিনব্যাপী সামিট শুরু হয়েছে। সামিটের সহযোগিতা করছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, কন্ট্রোলার অব সার্টিফাইং অথরিটিজ এবং উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস ফিন্যান্স ইনিশিয়েটিভ (উই-ফাই)। শুক্রবার সকাল ১০টায় রাজধানীর কুড়িলে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় ‘উইমেন ই-কমার্স এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ সামিট ২০২৩’ উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, এমপি। উই প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি এবং এবারের উই সামিটের আহ্বায়ক নাসিমা আক্তার নিশার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন উই ট্রাস্ট-এর উপদেষ্টা জাহানুর কবির সাকিব। তিনি বলেন, এক বছর পর আমরা আবার এক পেরেছি। এটা খুব আনন্দের। উই যাত্রা শুরুর কথা তুলে ধরার পাশাপাশি তিনি এ সময় উই সামিটকে সহযোগিতা করায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ জানান। প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, দেশে নারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। দেশের এই বিরাট সংখ্যক নারীর মধ্যে উই এখন অন্তত ৫-৬ লাখ নারীকে একত্রিত করেছে। যদি এটা কোনোভাবে আর ৬-৮ গুন হয়, তাহলে সেটা কী হবে একবার ভেবে দেখুন। সারা দেশে এখন তারা কাজ করছেন। এটা তখন বিশ্ব দরবারে পৌছাতে সময় লাগবে না। তিনি বলেন, আমাদের দেশের নারীরা এমন এক পরিবেশ থেকে যুদ্ধ করে আসেন, যখন তারা উদ্যোক্তা হয়, তখন একটি পুরো পরিবার তাতে জড়িয়ে যায়। স্বচ্ছল হয়ে যান। উই সেই কাজটিই করছে নীরবে। এরপর তিনি উই সামিট ২০২৩-এর উদ্বোধন ঘোষণা করেন। ভিডিও বার্তায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। তাঁরাই আমাদের আজকের স্মার্ট বাংলাদেশের সূচনা করিয়ে দিয়েছেন। ই-কমার্স সফল করতে তাঁরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, কোভিডসময়ে আমাদের লাইফলাইন ছিল ই-কমার্স। তখন থেকে এই পর্যায়ে এসে একটা সফল উদ্যোগও বলা যায় দেশের ই-কমার্স। করোনার পর এক কোরবানির ঈদেই প্রায় চার লাখ কোরবানির পশু বিক্রি হয় ই-কমার্সে। তখন ২৭০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় অনলাইনে। যা ছিল অভূতপূর্ব। সেই ধারাবাহিকতা এখনও বজায় আছে। তিনি বলেন, উই মানে আমরা। আমরা সবাই মিলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করি। সেটা বাস্তবে রূপ দেন উই প্রতিষ্ঠাতা নাসিমা আক্তার নিশা। তিনি দেশের নারী উদ্যোক্তাদের একত্রিত করেছেন। তাদের বিভিন্ন পণ্য দেশ বিদেশে পরিচিত করিয়েছেন। \ এ সময় তিনি আইসিটি বিভাগের নেয়া নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন। আইসিটি বিভাগ থেকে আর্থিক সুবিধাসহ নানা ধরনের স্কিলস ডেভেলপমেন্টের কথা তুলে ধরেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অপারেশন অফিসার গায়লে মার্টিন বলেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য কাজ করছে। প্রান্তিক পর্যায়ের ই-কমার্স থেকে শুরু করে এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সহজলভ্য করে দিতে কাজ করছে। এ কাজে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সঙ্গে আইসিটি বিভাগ সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। উই দেশের সবচেয়ে বড় নারীদের নিয়ে কাজ করা প্ল্যাটফর্ম। যারা প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের বিশ্বব্যাপী তাদের পণ্য পৌঁছে দিতে কাজ করায় ধন্যবাদ জানান তিনি। এ ছাড়া বিশেষ অতিরি বক্তব্য দেন দারাজের সিওও তাসফিন আলম। তিনি বলেন, দারাজ দেশের সবচেয়ে বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেশে উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করছে শুরু থেকেই। এখন এমন উদ্যোক্তাদের জন্য তারা একটা বিশেষ অ্যাপ এনেছে। সেখানে অনেক ধরনের সুবিধাও পাবেন নারী উদ্যোক্তারা বলে জানান তিনি। এমজিআই গ্রুপের পরিচালক ব্যারিস্টার তাসনিম মোস্তাফা তিনি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে নারীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার কথা জানান। বলেন, আমাদের সমাজে নারীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা খুব কঠিন। সেটা সামলে সামনে এগোনো খুব কঠিন। এমজিআই গ্রুপ নারীদের যেকেনো আইনি সহায়তা দেয় বলেও জানান। বাংলাদেশ হাইটেক পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিএসএম জাফরুল্লাহ বলেন, তরুণদের ওপর ভরসা করেই দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ভিশন নেওয়ার সাহস করা হয়েছে। তরুণদের জন্য উই এমন একটা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে উঠেছে যেখানে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। সেখানে একটি ডাক দিলে সহস্র সহস্র
উদ্যোক্তা সামনে এসে হাজির হন। আমি এখানে এসে নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে যে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখেছি তা সামনে এগিয়ে যাওয়ার, পেছনে ফিরে তাকানোর নয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সিসিএ কন্ট্রোলার এটিএম জিয়াউল ইসলাম। তিনি বলেন, গ্রামীণ পর্যায় থেকে যেসব উদ্যোক্তা কাজ করছেন তাদের সঙ্গে আমরা কাজ করি। উই এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে কয়েক লাখ সদস্য যুক্ত, যা দেশের ই-কমার্সকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে। আমরা এখন স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন নিয়ে এগিয়ে যাব। আপনারা যারা উদ্যোক্তা আছেন, আমরা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে এগিয়ে যাবো বলে বিশ্বাস করি। এ সময় তিনি সব খাতের উদ্যোক্তাদের এক হয়ে কাজ করার জন্য ধন্যবাদ জানান। উইমেন ই-কমার্স এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ সামিট ২০২৩- নিয়ে উই ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, গত তিন মাস ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে নারী উদ্যোক্তাদের নানা সুবিধা অসুবিধাগুলো শুনেছি। দুদিনের এই আয়োজনে সেগুলো সমাধানের লক্ষে বেশ কিছু প্যানেল আলোচনা থাকবে, আপনারা সেগুলো নোট করবেন। সেখান থেকে আপনারা জানতে পারবেন সমস্যার সমাধান কীভাবে পাবেন। এ সময় তিনি উই উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানান। সে সঙ্গে তিনি এক উদ্যোক্তা অন্যদের সহযোগিতা যেন অব্যাহত রাখেন সে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, নতুন সব পণ্য আনতে হবে। নিজেদের রিসার্চ করে দেখতে হবে বহির্বিশ্ব কি করছে, কতটা ইনোভেশন আনছে সেগুলো জানতে হবে। তবেই একজন উদ্যোক্তা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন হবেন। নারী উদ্যোক্তাদের তিনি বিভিন্ন স্কিলস শেখার আহ্বান জানান। বিশাল পরিসরে দুই দিনের ওই সামিটে রয়েছে সারা দেশ থেকে অংশ নেওয়া নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন সেশন, অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য, সেমিনার, কর্মশালাসহ বিশেষ সব আয়োজন।
উদ্বোধনের পর শুরু হয় একটি কি-নোট প্রেজেন্টেশনসহ প্যানেল সেশন। প্রথম দিনে রয়েছে ছয়টি প্যানেল আলোচনাসহ কর্মশালা ও ইনফ্লুয়েন্সার স্পিচ। এসব সেশনে বিশেষ আলোচক হিসেবে দেশ-বিদেশের অসংখ্য বক্তা ও বিভিন্ন খাতের স্বনামধন্য ব্যক্তিরা অংশ নেবেন। পাশাপাশি থাকছে ই-কমার্স খাতের এবং খাত সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞদের সঙ্গে নতুনদের নেটওয়ার্কিং সেশনও। থাকবে র্যাফেল ড্র। দ্বিতীয় দিনে থাকছে দুটি কর্মশালা, একটি সেমিনার। এছাড়া অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে এবার দেশের বিভিন্ন খাতে অবদান রাখা ১০ জন নারীকে জয়ী সম্মাননা
দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি উইয়ের সদস্যদের মধ্য থেকে ১০ নারী উদ্যোক্তাকে জয়ী পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। সারা দেশ থেকে যেসব নারীরা ই-কমার্সের মাধ্যমে তাদের পণ্য দেশ ও বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে অসামান্য অবদান রাখছেন তাদের এই বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। সামিটের দ্বিতীয় দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই পুরস্কার তুলে দিবেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ডিএমপি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন সিটিটিসির এডিসি নাজমুল ইসলাম, আইসিটি অধিদপ্তরের ডিজি মোস্তাফা কামাল, ডন সামদানী ফ্যাসিলিটিশন কনসালটেশনের গোলাম সামদানী ডন, টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিক, দারাজের সিওও খন্দকার তাসফিন আলম, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ইকোনোমিক অফিসার জেমস গার্ডিনার, ডা. সুষমা রেজা, রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ন কবীর, এটুআইয়ের পলিসি অ্যাডভাইসার আনীর চৌধুরী, পুচি ফ্যামিলির ওনার তাপসি দাস, ডান অ্যান্ড ব্র্যান্ডস্ট্রিট ডেটা অ্যান্ড অ্যানালিটিক্সের সিইও জারা মাহবুব, এসআর ভেঞ্চার অ্যান্ড কনসালটেন্সির সিইও সায়মা রহমান, ডেইলি স্টারের প্রধান বিজনেস কর্মকর্তা তাজদিন হাসান, লেখক ও পরিচালক সাদাত হোসাইনসহ আরও অনেকেই দুই দিনের এই সামিটে আলোচক হিসেবে অংশ নেবেন। এছাড়া এজেআই গ্রুপের চেয়ারম্যান অ্যান্ড এমডি অনন্ত জলিল, চলচ্চিত্র অভিনেত্রী আফিয়া নূসরাত বর্ষা, আফসানা মিমি, আফসানা আরা বিন্দু, জাকিয়া বারি মম, রুনা খান, মাসুমা রহমান নাবিলা প্রমুখ এর অংশগ্রহণ এবারের আয়োজনকে ভিন্ন মাত্রা দেবে। নাসিমা আক্তার নিশা জানান, দুই দিনের সামিট শেষ হবে শনিবার রাতে উই উদ্যোক্তাদের ফ্যাশন শো-এর মাধ্যমে। এবারের আয়োজনে প্ল্যাটিনাম স্পন্সর হিসেবে রয়েছে দারাজ ও ফ্রেশ অনন্যা স্যানিটরি ন্যাপকিন। এছাড়া পেমেন্ট পার্টনার হিসেবে বিকাশ, ব্যাংকিং পার্টনার হিসেবে প্রাইম ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স পার্টনার হিসেবে গ্রিন ডেলটা ইন্স্যুরেন্স, নিউট্রিশন পার্টনার হিসেবে থাকছে শক্তি। তাছাড়ও পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, রানার মোটরসাইকেল, ই-ক্যাব, ফ্লোরা টেলিকম, জিরোক্যাল এবং লাইভ ব্রডকাস্ট পার্টনার হিসেবে থাকছে ঢাকা লাইভ।